নারীবান্ধব বাজার কাঠামো

গুড়া গাবতলীর দুর্গাঘাটা ইউনিয়নের শিরিন বেগম ১৬ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ছেলে বেকার হওয়া সত্ত্বেও শ্বশুরের ভিটাবাড়ি দেখে মেয়েকে তুলে দেন শিরিনের বাবা। প্রথম বছরটি ভালোই কাটে। কিন্তু বিপত্তি বাধে এর কিছুদিন পর। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় বেকার ছেলে ও ছেলেবউকে আলাদা বাসা নিতে বলেন শ্বশুর-শাশুড়ি। শিরিন ও তার স্বামী মিঠুর হাত তখন একেবারে খালি। কীভাবে সংসার চালাবেন, সেই চিন্তায় অন্ধকার নেমে আসে তাদের জীবনে। এক বেলা খাবার জোটে তো, পরের বেলা উপোস। 

এভাবেই চলে কয়েক বছর। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান সুমাইয়া আক্তার মীম স্কুলে যাওয়া শুরু করলে বাসা থেকে টিফিন দিয়ে দিতেন শিরিন। তবে স্কুলের পথটুকুু যাওয়ার গাড়ি ভাড়া পাঁচ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তার। মেয়েকে তাই দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হতো স্কুলে। ছোট্ট মেয়ের গুটিগুটি পায়ের কষ্ট এখনও পোড়ায় তাদের। 

কষ্টের দিন একসময় বদলায়, তাদেরও বদলেছে। ২০১৫ সালে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আসিয়াবের মাধ্যমে 'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)' বা নারীর জন্য বাজার তৈরি নামের একটি প্রকল্প বগুড়ার গাবতলীতে বাস্তবায়ন শুরু করলে শিরিন তাতে নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি কৃষিপণ্যের আধুনিক উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনার ওপর ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ফলে তার উৎপাদিত পণ্য প্রকল্পের কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র অর্থাৎ কালেকশন পয়েন্টে বিক্রয়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন শিরিন। 

শিরিন শুধু একাই স্বাবলম্বী হননি, কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্রভিত্তিক নারীবান্ধব উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় নতুন ভাবনার আলোকে তার ইউনিয়নের আরও দুইশ নারীকে দাঁড় করিয়েছেন নিজের পায়ে। তিনি নিজের আয়ে চার শতাংশ জমি কিনেছেন। গড়েছেন 'মেসার্স মীম স্টোর' নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। উদ্যোক্তা নারীদের নিয়ে শুরু করেছেন দুর্গাঘাটা ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের কাজ, সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের পায়ের নিচের মাটি আরও শক্ত করতে। 

শিরিনের স্বপ্ন এখন তৃণমূল নারীদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার। তিনি জানান, গাবতলী থানার সাতটি ইউনিয়নে মোট নারী উদ্যোক্তা আছেন এক হাজার ২৭৯ জন ও পুরুষ রয়েছেন দুই শতাধিক। এ ছাড়া শুধু তার নিজের ভান্ডারা ইউনিয়নেই রয়েছেন ২০০ নারী উদ্যোক্তা। সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদকও তিনি। 

নেপালতলীর ডওর গ্রামের নাইচ আক্তারও শিরিনের মতোই তার ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তারও নিজের ভিটেমাটি ছিল না, তিনি এখন ১২ বিঘা জমির মালিক। নানা রকমের সবজির আবাদ করেন তিনি। তার স্বামী সাজেদুর রহমান শাহীন, স্ত্রীর ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন। সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে নাইচ ও তার দল স্থানীয় বাজারের মার্কেটের শেড পরিচালনা করেন। সরাসরি আড়তদারদের কাছে পণ্য বিক্রি করেন। 

তিনি সমকালকে বলেন, নেপালতলী ইউনিয়নে মোট নারী উদ্যোক্তা ২৩৫ জন। তাদের মধ্যে মার্কেট শেডে বসেন সাতজন। বাজারে বসা নিয়ে কত কুসংস্কার শুনতে হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, মেয়েরা যেন বাজারে না বসে। ঘরের বউ যেন ঘরেই থাকে। অসংখ্য কটূক্তি শুনতে হয়েছে। তবে সে অবস্থা অতিক্রম করেছেন তারা।

তিনি জানান, কৃষিজাত পণ্যের পাশাপাশি দেশি মুরগি বিক্রি করেন তিনি। ডিমও বিক্রি করেন। নিজের প্রায় দেড় বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ করেন। তার আবাদ করা ফসল বছরে বিক্রি করেন ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। উৎপাদন ব্যয় বাদে লাভ থাকে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। পাঁচ থেকে সাতজন শ্রমিক কাজ করেন তার সঙ্গে।

কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র নিয়ে শিরিন ও নাইচসহ অন্য নারী উদ্যোক্তারা জানান, এ জায়গাটি শুধু কৃষিপণ্য বিক্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে না; বরং স্থানীয়দের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এটি এখন বিভিন্ন সরকারি সেবা সংস্থার পরামর্শ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যেমন, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা এখন কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্রে বসে নারী-পুরুষ সব কৃষককে কৃষি বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে এর মাধ্যমে হাঁস-মুরগি এবং গরু-ছাগলের বিভিন্ন টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে, পরিবার পরিকল্পনা অফিস টিকাদান কেন্দ্র ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। 

কৃষিপণ্য বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন উপকরণ কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদন পদ্ধতি, উপকরণ প্রয়োগ মাত্রা, কোন ক্ষেত্রে কোন বালাইনাশক কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে- এরূপ নানা বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন সংশ্নিষ্টরা। 'কালেকশন পয়েন্ট' এখন 'বিজনেস রিসোর্স সেন্টার' বা বাণিজ্যিক সম্পদ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। 

'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন' প্রকল্প কী :বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থা গ্রামীণ জনপদে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নের একটি বড় অন্তরায়। গ্রামীণ বাজারগুলোতে নারীদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো অবকাঠামো নেই, আলাদা টয়লেট বা নারীদের জন্য উপযোগী স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা নেই, ব্রেস্টফিডিং অথবা বিশ্রাম নেওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই, যা নারীর জন্য অপরিহার্য। এ ছাড়া বাজারে নারীদের নিরাপত্তার অভাব, পুরুষ ব্যবসায়ীদের অবজ্ঞা, নারীদের পণ্যের কম মূল্য পরিশোধ, নারীদের বাজারে প্রবেশে বাধা, পুরুষ ব্যবসায়ীদের নারী ব্যবসায়ীদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। 

এই বাস্তবতাকে ভাঙতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ 'মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ) নামে একটি প্রকল্প পটুয়াখালীর গলাচিপা, ফরিদপুরের সদর ও মধুখালী, বগুড়ার গাবতলী এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি বিদ্যমান গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থায় টেকসই ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে কাজ করছে। এটা গ্রামীণ নারীদের কৃষি ভ্যালু চেইনে কাজ করতে সক্ষম করে তুলছে এবং উদ্দীষ্ট নারী জনগোষ্ঠীর উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার এবং মুনাফা অর্জনের সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাচ্ছে।

প্রকল্প সম্পর্কে অ্যাকশনএইডের এমএমডব্লিউডব্লিউ প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার-অ্যাডভোকেসি জাকিরুল ইসলাম পিটার জানান, এই প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে বিক্রয় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পের আওতায় কমিউনিটি পর্যায়ে ৬৭টি নারীবান্ধব কালেকশন পয়েন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে নারীদের প্রবেশকে উৎসাহিত করার জন্য বাজারে নারীবান্ধব ২২টি মার্কেট শেড নির্মাণ করা হয়েছে।

তিনি জানান, ওইসব কালেকশন পয়েন্ট ও মার্কেট শেডগুলোতে নারীদের সুবিধার্থে টয়লেট, নলকূপ, ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের বাণিজ্যিকভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদন, আধুনিক বাজারজাতকরণ পদ্ধতি এবং ভ্যালু চেইন বিশ্নেষণসহ সংশ্নিষ্ট নানাবিধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ফলে প্রকল্প এলাকার নারীদের কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং বাজারে তাদের প্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

জাকিরুল জানান, নারী উদ্যোক্তারা স্থানীয় পর্যায়ের পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কালেকশন পয়েন্টের মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত অধিকাংশ পণ্য রাজধানীর ফার্মগেটের পাইকার বা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। ফলে তাদের পণ্য বিক্রি পরিবহন খরচ লাগছে না, খাজনা দিতে হয় না, পণ্য বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকছে, বিক্রয়ে সময় কম লাগে, যা তারা কৃষি কাজে অথবা বাড়ির অন্যান্য কাজে ব্যয় করতে পারেন।

তিনি বলেন, কালেকশন পয়েন্টকে তারা উৎপাদন ও বিপণন সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ ও সেবা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে গ্রামীণ নারী কৃষি-উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের কিছু অংশ মার্কেট শেডের মাধ্যমেও ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করছেন। আবার গ্রামীণ নারী কৃষি-উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত পণ্য অন্য নারীরা কিনে স্থানীয় বাজারের মার্কেট শেডের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করছেন।

নারী উদ্যোক্তাদের অ্যাসোসিয়েশন :প্রকল্পের আওতায় নারী কৃষি-উদ্যোক্তাদের নিয়ে ইউনিয়ন ও উপজেলা অ্যাসোসিয়েশন (সমিতি) গঠন করা হয়েছে এবং সরকারের সংশ্নিষ্ট দপ্তর থেকে এ সংগঠনগুলোর রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করা হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে টেকসই করার জন্য তারা কীভাবে তহবিল সংগ্রহ করবেন, কীভাবে সংগৃহীত তহবিল ব্যয় করবেন, কীভাবে হিসাব সংরক্ষণ করবেন ইত্যাদি সব বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালা সম্পর্কিত গাইডলাইন প্রস্তুতি করে তাদের সরবরাহ করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে গ্রামীণ নারী কৃষি-উদ্যোক্তারা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আওতায় নিজেদের সংগঠিত করছেন, যা তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক অধিকার ও ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করছে। এভাবে কালেকশন পয়েন্ট এবং মার্কেট শেডগুলো গ্রামীণ নারী কৃষি-উদ্যোক্তা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তা ছাড়া অ্যাসোসিয়েশনগুলো পরবর্তীতে নিজেরাই ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল দপ্তরে তাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ এলাকার বাজারগুলোতে নারীবান্ধব কালেকশন পয়েন্ট ও মার্কেট শেড নির্মাণ করার জন্য অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ফলে গ্রামীণ এলাকায় নারী কৃষি-উদ্যোক্তা বিকাশে গতিশীলতা আসবে বলে জানান প্রকল্প কর্মকর্তারা।

প্রকল্পের সমন্বয়ক ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, গ্রামীণ এলাকায় নারী কৃষি-উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, পারিবারিক সম্পদের ওপর মালিকানাসহ নারীর অন্যান্য অধিকার অর্জনকে ত্বরান্বিত করা যায়। এটা জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এজন্য ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে এই প্রকল্প শুরু হয়। তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প শুরু হয় তার অনেকটাই অর্জিত হয়েছে। এমনকী সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কৃষি খাতে নারীবান্ধব বাজার ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কাজ করেছি। প্রকল্পটি নারী উদ্যোক্তাবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং জয়িতা ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও কাজ করছে। 

তিনি বলেন, সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারীরা নিজেদের 'ব্যবসায়ী' হিসেবে ভাবতে পারতেন না। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এ মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে।